‘স্বচ্ছ ভারত,’ তবে শুধু বিরোধীদের জন্য!

আর্থিক নয়ছয় বিরোধী আইন (প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট বা পিএমএলএ)— কোনও সন্দেহ নেই যে, এই আইনই আজ মোদী সরকারের সব থেকে শক্তিশালী ও মারাত্মক অস্ত্র।

এই আইনে বলীয়ান হওয়ায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে যা ক্ষমতা আছে, তা অন্তত পুলিশের হাতে নেই। বিরোধীদের অভিযোগ, এই আইনকে হাতিয়ার করে বেছে-বেছে শুধু বিরোধীদের নিশানা করছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। শুধু বিরোধী নেতাদেরই পড়তে হচ্ছে ইডি-র তদন্তের মুখে। সেই ইডি, যা কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অংশ।

বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায় শিরোধার্য। কিন্তু তবু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, সম্প্রতি বিচারপতি এ এম খানউইলকরের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ যে রায় দিয়েছে, এবং তাতে ইডি-র ক্ষমতায় যে ভাবে সিলমোহর বসেছে, তাতে দেশে আরও সঙ্কুচিত হবে বিরোধিতার পরিসর। প্রশ্নের মুখে পড়বে গণতন্ত্র। ওই রায় দেওয়ার দু’দিন পরেই ২৭ জুলাই অবসর গ্রহণ করেছেন খানউইলকর।

বিরোধীদের এমন আশঙ্কা কেন? তৃণমূল কংগ্রেস থেকে কংগ্রেস— প্রায় সমস্ত বিরোধী দলের নেতারাই বলছেন, মোদী সরকার যে যে ক্ষমতা ইডি-র হাতে চেয়েছিল, তার সবই এখন ওই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির হাতে। তাঁদের মতে, এ আইন ভয়ঙ্কর। যে ভাবে তা তৈরি করা হয়েছে, তা আরও ভীতিপ্রদ এবং সাংবিধানিক নীতির পরিপন্থী। কেন? প্রথমে কিছু তথ্য দেখা যাক।  
 

পিএমএলএ তৈরি হয়েছিল ২০০২ সালে। প্রধানমন্ত্রীর মসনদে তখন অটলবিহারী বাজপেয়ী। তার পরে বহু বার এর সংশোধন হয়েছে। ২০০৯, ২০১২ সালে ইউপিএ সরকারের জমানাতেও জারি থেকেছে সংশোধনের প্রক্রিয়া। কিন্তু ২০১৯ সালের অগস্টে, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদীর জমানায় যে সংশোধনী আনা হয়, তা ভয়ঙ্কর। তার দরুন ইডি-র হাতে এখন যা ক্ষমতা, তা অকল্পনীয়।

কী রকম?

আগে ৪০টি অপরাধের তদন্তে পিএমএলএ প্রয়োগ করা যেত। এখন তা করা যায় ১৪০টি অপরাধে। 

শুধু তা-ই নয়। যে কাউকে পুলিশ থানায় ডাকতে চাইলে, আগে তাদের লিখিত ভাবে জানাতে হয় যে, সেই ডাকের কারণ কী? বলতে হয়, যাঁর ডাক পড়ল, তিনি কি কোনও অপরাধে সন্দেহের আতসকাচের তলায়? নাকি  অপরাধের সাক্ষী? কিন্তু এই সমস্ত কৈফিয়তের দায়ই ইডি-র নেই। আগাম বলার প্রয়োজনই নেই যে, কেন কাউকে ডাকছে তারা।

দ্বিতীয়ত, পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে কেউ নিজেকে দোষী বলে কবুল করলেও, তা আদালতে প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয় না।  অর্থাৎ, জেরায় চাপের মুখে তা করা হয়ে থাকতে পারে বলে তাকে প্রমাণ হিসেবে দেখে না আদালত। কোর্টে দোষ প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু পিএমএলএ-তে তারও বালাই নেই।

পুলিশ কাউকে ডাকতে চাইলে, আগে এফআইআর প্রয়োজন। ইডি ডাকলে, ইএসআইআর। তার দু’মাসের মধ্যে চার্জশিট। কিন্তু মজা হল, এই মাঝের দু’মাসে আটক ব্যক্তি অনেক সময় জানেনও না যে, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগটি কী!

সাধারণত কোনও অপরাধে কেউ আটক বা গ্রেফতার হলে, সেই দোষ প্রমাণের দায় পুলিশের। পিএমএলএ-র ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক উল্টো। এই আইনে কেউ আটক বা গ্রেফতার হলে, নির্দোষ প্রমাণের দায় (বার্ডেন অব প্রুফ) তাঁর নিজেরই।

সমস্যা জামিনেও। কতখানি? একটা উদাহরণেই বিষয়টি কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে। সন্ত্রাসবিরোধী কড়া ইউএপিএ আইনে কেউ আটক হলে, প্রাথমিক ভাবে তাঁকে দোষী মনে না হলে, অন্তত দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগে পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করতে পারে আদালত। কিন্তু পিএমএলএ-তে জামিন মিলবে একমাত্র নির্দোষ প্রমাণ হলে।   

পিএমএলএ-র দৌলতে অভিযোগ বলার আগেই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে ইডি। ২০১৯ সালের সংশোধনী অনুযায়ী, পুরনো কেস ফের শুরু করা যেতে পারে। এমনকি খুলতে পারে ২০ বছর আগের ফাইলও।

এমন আরও বহু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু শুধু তথ্য দিয়ে পাঠকদের ভারাক্রান্ত করতে চাই না। যা নিয়ে বিতর্ক, তা হল, এই আইনে যাবতীয় পদক্ষেপ শুধু বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধেই কেন নিচ্ছে ইডি?

বিরোধী বলতে কারা? উদাহরণ অজস্র। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে না হয় এখন তুলকালাম হচ্ছে। কিন্তু তার আগে এই দলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মদন মিত্র, ফিরহাদ হাকিম (ববি), কুণাল ঘোষ, সৌগত রায়দেরও পিএমএলএ-র বলে ডেকেছে ইডি। কংগ্রেসের সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে পি চিদম্বরম, ভূপিন্দর সিংহ হুডা, বি কে শিবকুমার,  পঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ চন্নীর ভাই, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলতের ভাই পর্যন্ত ইডি-র নিশানায়।

বাদ নেই অন্যান্য বিরোধী দলও। এনসিপি-র শরদ পওয়ার, অনিল দেশমুখ, নবাব মালিক। শিবসেনার সঞ্জয় রাউত, উদ্ধব ঠাকরের ভগ্নীপতি। আরজেডি-র লালুপ্রসাদ যাদব, তাঁর ছেলে তেজস্বী যাদব ও মেয়ে মিশা ভারতী। আপ-এর সত্যেন্দ্র জৈন। ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লা। এমন বহু বিরোধী নাম ইডি-র তদন্তের আতস কাচের নীচে। 

সুপ্রিম কোর্টকে ১২২ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির নামের তালিকা দিয়েছিল ইডি। যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়ার কথা।  এর মধ্যে বি এস ইয়েদুরাপ্পা (কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী), শুভেন্দু অধিকারী (নারদ-কাণ্ডে অভিযুক্ত) মিঠুন চক্রবর্তীর মতো বিজেপি নেতার নামও রয়েছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার নাম তো নিজে বলেছিলেন বেআইনি লগ্নি সংস্থা সারদা-র প্রাক্তন কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। বিরোধীদের প্রশ্ন, এঁদের বিরুদ্ধে ইডি-র তৎপরতা কোথায়? সেই কারণেই বিজেপিকে ‘ওয়াশিং মেশিন’ বলে কটাক্ষ করছেন তাঁরা।

২০০৪ থেকে ২০১৪— এই এক দশকে ইডি তল্লাশি ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিল ১১২টি ক্ষেত্রে। ২০১৪ থেকে ২০২২— এই আট বছরে সেই সংখ্যা বেড়েছে ২৬ গুণ। এই আট বছরে কেস নথিভুক্তির সংখ্যাও আট গুণ বেড়েছে। তল্লাশি জারি থেকেছে কোভিডের সময়ে। পিএমএলএ কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৪৭০০টি কেস এর আওতায় এসেছে। এর প্রায় অর্ধেক (২২০০টি মতো) শুধু গত পাঁচ বছরে। বিরোধীরা বলছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান স্বাগত। কিন্তু এত তল্লাশির পরে এত দিনে মাত্র ২৩ জন দোষী সাব্যস্ত হলেন কী ভাবে? কেনই বা ইডি-র নিশানায় শুধু বিরোধীরা?

বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, রাজ্যসভাকে এড়িয়ে অর্থ বিলের মাধ্যমে পিএমএলএ সংশোধন করেছে মোদী সরকার। কিন্তু এ নিয়ে মামলা চলছে। আগামী দিনে সুপ্রিম কোর্টে ৭ বিচারপতির বেঞ্চ যদি বলে যে, ওই পদ্ধতি সাংবিধানিক নয়! তখন? এ নিয়ে ৩ অগস্ট চিঠি লিখেছে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম-সহ ১৭টি বিরোধী দল। অনেকের বক্তব্য, আগেও কংগ্রেসের সময়ে আইনের অপব্যবহার হয়েছে। কিন্তু কোনও একটি আইনকে ব্যবহার করে সরকারের তরফ থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নিশানা করার এমন দৃষ্টান্ত ভারতের ইতিহাসে নেই।

(মতামত ব্যক্তিগত)

Featured Book: As Author
Sue the Messenger
How legal harassment by corporates is shackling reportage and undermining democracy in India
 
Documentary: Featured
Featured Book: As Publisher
Junkland Journeys