জ্বলছে দ্বীপরাষ্ট্র। সংখ্যাগুরুবাদে বুঁদ হয়েই কি বিপত্তি

শ্রীলঙ্কা বিক্ষোভে উত্তাল।

গত কয়েক দিন ধরে প্রতিবাদ-আন্দোলনের যে ছবি ওই দ্বীপরাষ্ট্রে দেখা গিয়েছে, তা প্রায় অকল্পনীয়।

কাতারে-কাতারে মানুষ নেমে এসেছেন রাস্তায়। কারও হাতে দেশের জাতীয় পতাকা, কারও কোলে সন্তান। একযোগে ‘অপদার্থ’, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ শাসকদের থেকে কার্যত যে কোনও 
--

মূল্যে মুক্তি চাইছেন তাঁরা। আর সেই সূত্রেই তৈরি হচ্ছে অকল্পনীয় সমস্ত ছবির কোলাজ। 

যেমন, কয়েক দিন আগেই শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। তার পরে দেখা গেল, অগুনতি মানুষ ঢুকে পড়েছেন রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে। সেখানে গোতাবায়া রাজাপক্ষের সাধের সুইমিং পুলে কেউ সাঁতার কাটছেন, কেউ আবার চেয়ারে বসে তুলছেন নিজস্বী। কেউ প্রেসিডেন্টের রাজকীয় খাটে আধশোয়া, তো কেউ জিমে ব্যায়াম করছেন হাসিমুখে। ভাবখানা এই যে, ‘আমাদের পথে বসিয়ে নিজেদের জন্য যে বিপুল বিলাসের আয়োজন করেছিলে, এ বার তার দখল নিলাম আমরা।’

কিন্তু এই প্রাসাদ দখলের পুরো প্রক্রিয়াই আদ্যপান্ত শান্তিপূর্ণ। জিনিসপত্র নষ্ট করা নেই, লুটপাটও নেই। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাসভবন জ্বালিয়ে দেওয়ার সময়ে যে আগুনে রোষ আন্দোলনে ছিল, এ ক্ষেত্রে তা অনেক শান্তিপূর্ণ।

তা সত্ত্বেও পুলিশ অবশ্য কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে। মারা গিয়েছেন এক জন। ৮০ জনেরও বেশি হাসপাতালে ভর্তি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের উপরে এই পুলিশি আক্রমণ মরার উপরে খাঁড়ার ঘা নয় কি?

শ্রীলঙ্কায় তীব্র আর্থিক সঙ্কট চলছে আজ বেশ কয়েক মাস ধরে।  পাম্পে পেট্রল-ডিজ়েল নেই। কাগজ না থাকায় পড়ুয়াদের পরীক্ষা বন্ধ। বিদ্যুৎ নেই। খাবারের দাম এতটাই আকাশছোঁয়া যে, আধপেটা খেয়ে থাকতে হচ্ছে বহু মানুষকে। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে পুরোপুরি।

২০০৫ থেকে ২০১৫। তার পরে ফের ২০১৯ থেকে এ পর্যন্ত— মাঝে পাঁচ বছর বাদে টানা দ্বীপরাষ্ট্র শাসন করে গিয়েছে রাজাপক্ষে পরিবার এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ জনেরা। এক সময়ে তামিল জঙ্গি আন্দোলন (এলটিটিই) নিকেশ করার জন্য সিংহলিদের মধ্যে (দ্বীপরাষ্ট্রে যাঁরা সংখ্যাগুরু) তাঁদের জনপ্রিয়তা ছিল যথেষ্ট। কিন্তু অর্থনীতির হাল যত বিগড়াতে থাকল, যত সামনে আসতে থাকল একের পর এক দুর্নীতির কঙ্কাল, তত যেন মোহভঙ্গ হল মানুষের। প্রথমে ক্ষোভ, তার থেকে রাগ, তা থেকে আন্দোলন। পেটে টান পড়লে, কত দিন আর মানুষ চুপ থাকবে?

কিন্তু গোতাবায়া তাতেও বিলাসবহুল বাড়ি, পদ এবং ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ! একে তো পরিবারের সকলেই প্রায় মন্ত্রী-সান্ত্রী। তার উপরে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার পরেও বিশ্বস্তদের সামনে খাড়া করে পিছন থেকে ক্ষমতা দখলে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল রাজাপক্ষে পরিবার। তাতেই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল সাধারণ মানুষের। তখনই তারা পুড়িয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি, গাড়ি। ‘দখল নিলেন’ রাষ্ট্রপতি ভবনের।

জনরোষের ভয়ে শেষমেশ নৌসেনার জাহাজে চড়ে, পেল্লাই সমস্ত সুটকেস নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন গোতাবায়া। প্রথমে আকাশপথে মলদ্বীপ। কিন্তু ওই মুসলিম-প্রধান দেশে তাঁর বিরুদ্ধে পথে নামলেন অনেকে। তাই সেখান থেকে সিঙ্গাপুর। রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফাও সেখান থেকে।

কিন্তু মুসলিমদের ক্ষোভ কেন?

শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২০ লক্ষ। তার ১০ শতাংশের কম মুসলমান। খ্রিস্টান ১.৩ শতাংশ। আর হিন্দু, যাঁদের অধিকাংশই তামিলভাষী, তাঁরা ১৩ শতাংশ। বাকি প্রায় ৭৫ শতাংশই সিংহলি। যাঁদের অধিকাংশই বৌদ্ধ।

রাজাপক্ষে পরিবারের রাজনীতি ও বিচারধারা গোড়া থেকেই সংখ্যাগুরুবাদে বিশ্বাসী। প্রথম দিকে সেই সূত্রেই জনপ্রিয়তা। শ্রীলঙ্কায় তামিলরা আলাদা দেশ চেয়ে আন্দোলন শুরু করেন ১৯৭২ সাল থেকে। ২০০৯ সালে এলটিটিই প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে হত্যা করা পর্যন্ত তা জারি ছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব অনুযায়ী, ওই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে ২০ হাজার তামিলকে হত্যা করা হয়েছে। এই সূত্রেই এলটিটিই-র আত্মঘাতী জঙ্গি ১৯৯১ সালে কেড়ে নিয়েছে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর প্রাণ। কিন্তু শেষমেশ তামিল বিদ্রোহ দমনে খুশি সংখ্যাগুরু সিংহলিরা।

এর পরে শুরু হল ‘নতুন শত্রুর’ খোঁজ। এ বার নিশানা মুসলিমরা। সেই আগুনে ঘি ঢালল ২০১৯ সালের এপ্রিলে ইস্টার সানডে-তে ৩টি গির্জা ও ৩টি বড় হোটেলে জঙ্গি-হামলা। ৮ জন জঙ্গি এবং ৩৬৯ জন সাধারণ মানুষ তার বলি হলেন।

এর ফল হল দু’টি। প্রথমত, কথায়-কথায় মুসলিমদের কাঠগড়ায় তুলে তাঁদের ভিলেন ঠাওরাতে শুরু করল রাজাপক্ষে সরকার। তার আড়ালে চাপা পড়তে থাকল যাবতীয় রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক ব্যর্থতা। দেশের কাঁধে চাপল পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা। তা শোধ করতে গিয়ে ফের ধার। ক্রমশ ঋণের জালে জড়িয়ে গেল শ্রীলঙ্কা। দ্বিতীয়ত, ওই জঙ্গি হানার পরে ধাক্কা খেল পর্যটন। যা দ্বীপরাষ্ট্রের প্রধান রুজিরুটি। সেই কফিনে শেষ পেরেক অবশ্যই কোভিড।

এক সময়ে অর্থনীতি রসাতলে যাওয়ার পরে ঘুম ভাঙল সকলের। দেখা যাচ্ছে, এই আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাস্তায় নেমেছেন সিংহলি, মুসলমান, খ্রিস্টান— সকলে। কত দিন এই ঐক্য থাকবে, সেই উত্তর অবশ্য সময়ের গর্ভে। কিন্তু আপাতত এখন একজোট হওয়া ছাড়া সম্ভবত উপায়ও ছিল না তাঁদের। দেশের কাঁধে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ধার। পর্যটন প্রায় শেষ। তার উপরে শুধুমাত্র জৈব চাষের হঠকারী সিদ্ধান্ত। সব মিলিয়ে, অর্থনীতি বিধ্বস্ত।

এই কঠিন পরিস্থিতিতে কে শ্রীলঙ্কার হাল ধরবেন, তা আঁচ করা শক্ত। ২২৫ সদস্যের পার্লামেন্টে দৌড়ে আপাতত তিন জন:— 

শ্রীলঙ্কা পিপলস ফ্রন্টের (এসএলপিপি) রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে (৭৪)। এর আগে চার বার তিনি ক্ষমতা ভোগ করেছেন। তবে রাজাপক্ষে পরিবারের কাছের লোক হওয়ার সূত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা কম।

প্রধান বিরোধী দল এসজেবি-র সাজিত প্রেমদাস (৫৫)। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের এই প্রাক্তনীর বাবা রণসিঙ্ঘে প্রেমদাসের প্রাণ কেড়েছিল আত্মঘাতী জঙ্গি হানা।

আর তৃতীয় জন, এসএলপিপি ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া গোষ্ঠীর নেতা দুল্লাস আল্লাহপেরুমা (৬৩)। কত জন আগামী দিনে এই প্রাক্তন সাংবাদিকের হাত ধরতে রাজি হন, তা অবশ্য দেখার।

অনেকেই বলছেন, পড়শি দেশের এই ঘটনাক্রম থেকে অনেক কিছু শেখার আছে ভারতেরও। এ দেশেও সরকার সংখ্যাগুরুবাদের আড়ালে অর্থনীতির যাবতীয় সমস্যা আড়াল করতে চায়। নিশানা সেই মুসলিমরা। আর জ্বালানির আকাশছোঁয়া দাম, চড়া মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষকে বুঁদ করে রাখার চেষ্টা হচ্ছে শুধুমাত্র বিভাজনের রাজনীতিতে। তার উপরে একশো শতাংশ দক্ষিণপন্থী অর্থ ব্যবস্থার পথে হেঁটে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি।

ভারতও কি শেষে শ্রীলঙ্কা হওয়ার পথে হাঁটবে? হয়তো অতটা বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু আগে থাকতে সাবধানী হতে দোষ কী?  

Featured Book: As Author
Sue the Messenger
How legal harassment by corporates is shackling reportage and undermining democracy in India
 
Documentary: Featured
Featured Book: As Publisher
Flying Lies?
The Role of Prime Minister Narendra Modi in India's Biggest Defence Scandal
Also available: