ঔদ্ধত্যের উত্তর দিল দক্ষিণ

কর্নাটক নির্বাচনের ফলাফল দেখে কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিজেপি-বিরোধী দল স্বাভাবিক ভাবেই উচ্ছ্বসিত। অনেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে এমনও বলছেন, এ হল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একনায়কতন্ত্রের শেষের শুরু। এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর সময় হয়তো এখনও আসেনি। আগামী সাধারণ নির্বাচন এখনও অন্তত দশ মাস দূরে। তার মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।

তবুও কর্নাটক নির্বাচনের বিশেষ তাৎপর্য আছে। কারণ, এটা হল দক্ষিণ ভারতের প্রথম রাজ্য যেখানে গত দেড় দশক ধরে বার বার ঘুরেফিরে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। বর্তমানে দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্যের কোনওটিতেই ক্ষমতায় নেই বিজেপি। তা বলে পুরো দক্ষিণ ভারতকে ‘বিজেপি-মুক্ত’ বলে দাবি করা ভুল হবে। অন্ধ্রপ্রদেশের মু্খ্যমন্ত্রী ওয়াইএস জগন্মোহন রেড্ডি বিজেপির হাত সহজে ছাড়বেন না— জেলের বাইরে থাকতে হলে এটাই তাঁর সুরক্ষাকবচ। উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর মতোই অবস্থা তাঁরও।

২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হবে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় এবং ওড়িশাতেও। কর্নাটকের মতো, এই সব রাজ্যেও কি সাধারণ মানুষ বিধানসভা নির্বাচনের থেকে ভিন্ন ভাবে ভোট দেবেন লোকসভা নির্বাচনে? ২০১৮-১৯’এর নির্বাচনের ফলের পুনরাবৃত্তি হবে কি এই রাজ্যগুলোতে? ‘স্থানীয়’ প্রশ্নগুলি কি ‘জাতীয়’ প্রশ্নের থেকে অনেক আলাদা হয়ে উঠবে? এ সব প্রশ্নের কোনও সহজ উত্তর সম্ভব নয়। তবে এই সব প্রশ্নের উত্তর যদি হয় ‘না’, তা হলে মোদী সম্ভবত তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হবেন না।

মোদী অপরাজেয় নন, তা দেখাল কর্নাটক। সেই সঙ্গে এ-ও দেখাল যে, মুসলিমবিদ্বেষকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে, এবং সংখ্যালঘুদের শত্রু বলে দেখিয়ে, হিন্দু ভোট একত্র করা একটা সীমা পর্যন্তই সম্ভব। হিজাব পরা, লাভ জেহাদ, ছাগল কাটার পদ্ধতি নিয়ে বিবাদ, টিপু সুলতান থেকে হনুমান পর্যন্ত ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক চরিত্রের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ভ্রান্ত ব্যবহার, আর সেই সঙ্গে বেঙ্গালুরুতে মোদীর নিজস্ব প্রচার— এগুলো হয়তো বিজেপিকে নির্বাচনী ভরাডুবি থেকে বাঁচিয়েছে। বিজেপির ভোটের ভাগ অন্তত এক-তৃতীয়াংশের উপরে ধরে রাখতে পেরেছে, তার নীচে নামতে দেয়নি। কিন্তু জেতাতে পারেনি। তবে এর সঙ্গে হয়তো আমরা এটাও মাথায় রাখতে পারি, যে বিষয়গুলি কর্নাটকের ভোটদাতাদের উপর প্রভাব ফেলতে পারেনি, সেগুলিই হয়তো বিজেপির কাজে আসবে উত্তরপ্রদেশে (২৫৪টির মধ্যে ৮০টি আসন) এবং মহারাষ্ট্রে (৬৮টি আসন)।

ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি রাজধানী বেঙ্গালুরুর গেটবন্দি কলোনিতে আরাম-আয়েসে বাস করছে ভারতের উচ্চবিত্ত শ্রেণির যে মানুষেরা, তাঁরা কিন্তু এই নির্বাচনে বিজেপির পাশেই থাকলেন। এখানে আমরা লক্ষ করব, কী ভাবে শহুরে কর্নাটক আর গ্রামীণ কর্নাটক ভোট দিয়েছে আলাদা ভাবে। কেবল অর্থনৈতিক শ্রেণি নয়, যে বিশেষজ্ঞরা জাতি-বিচারের নিরিখে দেখছিলেন কর্নাটকের নির্বাচনকে, তাঁদেরও ভুল প্রমাণ করেছে ফলাফল। সর্বোপরি, যাঁরা ক্রমাগত প্রচার করছিলেন যে দুর্নীতি সাধারণ মানুষের কাছে কোনও বড় বিষয় নয়, তাঁদের এ বার সে কথাগুলো গিলে ফেলা দরকার। সেই সঙ্গে, কর্নাটকের ফলাফল এ-ও বলে দিচ্ছে যে, টাকা দিয়ে ভোটারদের উপর প্রভাব বিস্তারের কৌশল খুব বেশি দূর যেতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গেও ২০২১ সালে এটা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল। এই দু’টি রাজ্যেই যে সহজ বার্তা মিলেছে তা এই— নেতারা যদি কাছাকাছি না-ও আসতে পারেন, মানুষ আসবেন।

ঔদ্ধত্যে অন্ধ হয়ে গত কয়েক মাসে দিল্লির শাসকরা পর পর কয়েকটি ভুলভাল কাজ করে বসেছেন। একটি অসম্পূর্ণ তালিকা দেওয়া যেতে পারে। গোধরা কাণ্ডের উপর বিবিসি-র তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করা এবং তার পর সেই সংবাদ সংস্থার দফতরে আয়কর কর্তাদের পাঠিয়ে দেওয়া। গৌতম আদানির কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের উত্তরে নীরবতা বজায় রাখা। লোকসভার নথি থেকে রাহুল গান্ধীর বক্তব্য বাদ দেওয়া। দিল্লির ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রীকে জেলে পাঠানো। জম্মু ও কাশ্মীরে ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে পুলওয়ামার ঘটনা নিয়ে প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্য পাল মালিক যে সব আপত্তি তুলেছিলেন সেগুলো উপেক্ষা করা। এবং শাহরুখ খান-দীপিকা পাড়ুকোন অভিনীত পঠান ছবি দেখার থেকে দর্শকদের নিবৃত্ত করার হাস্যকর প্রচেষ্টা, যার ফল হল উল্টো— শেষ অবধি ছবিটি দর্শকসমাজে পেল বিপুল সাফল্য।

এর আগে শাহরুখ খানের ছেলেকে প্রায় এক মাস জেল খাটতে হয়েছিল মাদক ব্যবহারের অভিযোগে, যদিও তার সঙ্গে মাদক কখনওই পাওয়া যায়নি। নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর যে আধিকারিক আরিয়ান খানের মামলার তদন্ত করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধেই এখন ঘুষ আদায় করার অভিযোগ দায়ের করেছে সিবিআই। কেন এত কিছু ঘটল? এর কারণ কি এই যে শাহরুখ খান জনপ্রিয়, ধনী এবং সর্বোপরি এক জন মুসলিম ব্যক্তি— যিনি এক হিন্দু মহিলাকে বিয়ে করেছেন?

কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরা যখন প্রধানমন্ত্রীকে ‘নরেন্দ্র গৌতমদাস মোদী’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন, তখন হয়তো ভেবেছিলেন যে এটা তাঁর রসবোধের পরিচয়। বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার অধীন অসমের পুলিশ পবন খেরার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে, দিল্লি এয়ারপোর্টে হাজির হয় এবং বিমান থেকে তাঁকে নামায়। সেই দিন সন্ধ্যাতেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ওয়াইভি চন্দ্রচূড় খেরাকে জামিন দেন। এর পর দিল্লির ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়াকে জেলবন্দি করা হয় ঘুষ নিয়ে মদের লাইসেন্স দেওয়ার অভিযোগে। তার পর সিবিআই তলব করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল এবং প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্য পাল মালিককে। তা সত্ত্বেও বিধানসভায় কেজরীওয়াল দাবি করেন, “ওই টাকা আদানির নয়, ওটা মোদীর টাকা।” মানহানির মামলা থেকে অব্যাহতি পান বিধায়করা, সেটাই ব্যবহার করেছিলেন কেজরীওয়াল।

এই সব ঘটনাই ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিজেপির ঔদ্ধত্য তার নির্বুদ্ধিতাকে বাড়িয়ে তুলছে। হ্যাঁ, রাহুল গান্ধীর ভারতযাত্রা খেলাটাকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেসকেও বিনয়ের সঙ্গে কাজ করতে হবে, এবং সমাজবাদী পার্টি, আম আদমি পার্টি, বা তৃণমূলের মতো আঞ্চলিক দলগুলির রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাকে স্থান দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে কংগ্রেসকে কিছুটা স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে। কেবল তখনই পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে বিরোধী ঐক্য নির্মা‌ণ করা সম্ভব হতে পারে।

না কি, এখনই এতটা ভেবে ফেলা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? এখন থেকে তখনের মধ্যে অনেক কিছু ঘটতে পারে— কে জানে কী— ছোটখাটো যুদ্ধ থেকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা পর্যন্ত অনেক কিছু। রাজনীতিতে এক সপ্তাহই দীর্ঘ সময়। আট-নয় মাসকে তো একটা যুগ বলা যেতে পারে।

Featured Book: As Author
Flying Lies?
The Role of Prime Minister Narendra Modi in India's Biggest Defence Scandal
Also available:
 
Documentary: Featured
Featured Book: As Publisher
Junkland Journeys